স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্রের হাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাত বরণের পর বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। দেশে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সামরিক, বেসামরিক আদলে সেনা শাসন অব্যাহত ছিল।
১৯৯০ সালে ৬ই ডিসেম্বর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে; গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রা শুরু হয়। সকল দলের অংশগ্রহণে ১৯৯১ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক ধারা চালু হয়। সামরিক সরকারসমূহের দুঃশাসনের কবল থেকে মুক্ত হয়ে জনগণ দেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ধারা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। এ অগ্রযাত্রায় সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ এক বীরত্বপূর্ণ অবদান রাখে। একটি প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ জেল-জুলুম-নির্যাতন এমনকি মৃত্যুকে তুচ্ছজ্ঞান করে অকাতরে প্রাণ দেয়। জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধি কর্তৃক শাসনব্যবস্থা পরিচালনার পথ উন্মুক্ত হয়। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার থেকে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি দেশে পুনঃপ্রবর্তন ও সংবিধানে তা অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান ও গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রা
১৯৮২ সালের শেষ দিকে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায় ছাত্র সমাজ। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধান অক্ষুণ্ণ রেখে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৮৩ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দলীয় ঐক্যজোট এবং বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দলীয় জোট গঠিত হয়। ১৫ দল ও ৭ দল সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনকে সফল করার লক্ষ্যে ৫ দফা দাবি ঘোষণা করে। ৫ দফা কর্মসূচির মূল দাবি ছিল অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া এবং যে কোনো নির্বাচনের আগে সার্বভৌম জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠান ।
সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল বাংলাদেশের জনগণ ভালো চোখে দেখেনি। ফলে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দীর্ঘ প্রায় নয় বছরের শাসনকালে প্রবল গণআন্দোলনের সম্মুখীন হন। এ আন্দোলনে রাজনৈতিক দল ছাড়াও ছাত্র, শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, সাংবাদিক, কৃষিবিদ, কৃষক-শ্রমিকসহ সকল শ্রেণি ও পেশার জনগণ অংশ গ্রহণ করে। তাই এ আন্দোলন গণআন্দোলন থেকে ক্রমান্বয়ে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। উল্লিখিত ১৫ দল, ৭ দল, শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদসহ বিভিন্ন জোটের আন্দোলনের চাপে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রকাশ্য রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেন।
১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং ১৯৮৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর বদ্ধমূল ধারণা জন্মে যে, জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসন আমলে কোনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই ১৯৮৭ সালে ৮ দল, ৭ দল ও ৫ দল জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে একমত পোষণ করে এবং সকল জোট ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে। তিন জোটের হরতাল এবং ‘ঢাকা অবরোধ কর্মসূচির ফলে এরশাদবিরোধী আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। আন্দোলনের একপর্যায়ে ১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর নূর হোসেন বুকে ও পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক' স্লোগান লিখে ঢাকার জিপিও (জেনারেল পোস্ট অফিস)-এর নিকট জিরো পয়েন্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। এতে আন্দোলনকারী জনগণ ক্ষুব্ধ হয়। ১৯৮৭ সালের ১২ নভেম্বর শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। ২৭শে নভেম্বর এরশাদ সরকার দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। ১৯৮৮ সালের ২৪শে জানুয়ারি চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার এক সমাবেশে সরকারের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীরা নির্বিচারে জনতার ওপর গুলি চালায়। অল্পের জন্য শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পান। এর বিরুদ্ধে সমগ্র দেশ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। ১৯৯০ সালের ১০ই অক্টোবর বিরোধী জোট ও দলগুলোর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি রাজনৈতিক অঙ্গনকে উত্তপ্ত করে তোলে। ঐ দিন মিছিলে গুলিবর্ষণে ৫ জন নিহত এবং তিন শতাধিক আহত হয়। ১০ই অক্টোবর ২২টি ছাত্র সংগঠন 'সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য' গঠন করে এবং এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। বিরোধী দলের একের পর এক আন্দোলন ও কর্মসূচির কারণে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পিছু হটতে থাকেন। আন্দোলন থামানোর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেও এরশাদ সরকার আবার তা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। তিন জোট কর্তৃক জেনারেল এরশাদ ও তার সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের ফর্মুলাসহ একটি যৌথ ঘোষণা জাতির সমক্ষে উপস্থাপন করা হয়, যা 'তিন জোটের রূপরেখা' নামে খ্যাত। ২৭শে নভেম্বর বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ) নেতা ডা. সামসুল মুক্তি পাক আলম মিলনের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ এরশাদবিরোধী আন্দোলনকে চরম রূপ দেয়। ২৯শে নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ একযোগে পদত্যাগ করেন। পাশাপাশি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দও পদত্যাগের ঘোষণা দেন। সংগঠিত হয় এরশাদবিরোধী ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান। এ সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭ দলীয় জোট এবং ৫ দলীয় বাম জোট একটি অভিন্ন কর্মসূচিতে ঐক্যবদ্ধ হলে ১৯৯০-এর ৪ঠা ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন। ৬ই ডিসেম্বর তিন জোটের রূপরেখা অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে জেনারেল এরশাদ আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। নতুন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সামরিক শাসনের অবসান ঘটে এবং গণতন্ত্রের পুনর্যাত্রা শুরু হয়। সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে ১৯৯১ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক ধারা চালু হয়। সংসদীয় সরকার পদ্ধতি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় । দেশে অবাধ তথ্যপ্রবাহ সৃষ্টি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, পত্র-পত্রিকার ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার ইত্যাদির ব্যবস্থা হয়। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পৃথিবীতে পরিচিতি পায়। ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি ১৪০টি আসন লাভ করে। কিন্তু সরকার গঠনের জন্য ১৫১টি আসন প্রয়োজন হয়। এ অবস্থায় বিএনপি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে এবং বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। বিএনপি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত বেশ কয়েকটি উপনির্বাচনে যেমন- ১৯৯৪ সালের মাগুরার উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ উঠে। দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান আদৌ সম্ভব নয় বলে রাজনৈতিক মহলে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়। ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সকল দল ঐক্যবদ্ধ হয়। বিএনপি তা অগ্রাহ্য করে ১৯৯৬ সালে এককভাবে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচন করে। উক্ত নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা না পাওয়ায় ২৬শে মার্চ ১৯৯৬ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল সংসদে পাস হয় এবং ৩০শে মার্চ বিএনপি সরকার পদত্যাগ করে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন বিচারপতি হাবিবুর রহমান । এ সরকারের অধীনে ১২ই জুন ১৯৯৬ সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসন লাভ করে। জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে সমর্থন প্রদান করে এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। মেয়াদ শেষে আওয়ামী লীগ ২০০১ সালে দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০১ সালের ১লা অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট ২১৯টি আসন লাভ করে সরকার গঠন করে। নির্ধারিত মেয়াদ শেষে ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে সংকট তৈরি হয়। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠনবিধি উপেক্ষা করে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিজের ওপর নেন। এর ফলে সংকট আরও ঘনীভূত হয়। বিরোধী দল বিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। এরূপ অবস্থায় ২০০৭ সালের ১১ই জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে সরে দাঁড়ান এবং দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন। ১২ই জানুয়ারি সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে ড. ফখরুদ্দীন আহমদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন। এ সময়ে কার্যত সেনাবাহিনী দেশ পরিচালনা করতে থাকে। দেশের দুটি প্রধান দলের দুই নেত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। রাজনৈতিক সংস্কারের নামে বিরাজনীতিকীকরণ এবং সেনাশাসন দীর্ঘস্থায়ী করার নীলনকশা নিয়ে তারা অগ্রসর হয়। কিন্তু সেনাশাসনের অতীত তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকায় জনগণের প্রতিবাদ ও বিরোধিতায় তা সফল হয়নি। অতঃপর নির্বাচন কমিশন ছবিযুক্ত নতুন ভোটার তালিকা ও আচরণবিধি প্রণয়ন শেষে ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে। উক্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২৬২টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করে এবং শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। মহাজোট সরকার দেশের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের লক্ষণীয় অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখে শাসনকার্য পরিচালনা করেছে। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় ৫ই জানুয়ারি ২০১৪ দশম জাতীয় সংসদ এবং ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উভয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিজয়ী হয়ে বর্তমানে সরকার পরিচালনা করছে।
বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রযাত্রা
মুক্তিযুদ্ধে ধ্বংসযজ্ঞের পর বাংলাদেশ দারিদ্র্যপীড়িত দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৭০ শতাংশ। সরকারি বিভিন্ন নীতি ও কৃষক-শ্রমিকসহ জনগণের সম্মিলিত চেষ্টায় বাংলাদেশে গত ৪৬ বছরে দারিদ্র্যের হার ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত পাঁচটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও একটি দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য ছিল দারিদ্র্য বিমোচন। সরকারের গৃহীত বিভিন্ন নীতি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষকে দারিদ্র্য জয়ে সহযোগিতা করেছে। দারিদ্র্য হ্রাসের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচকে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচক দক্ষিণ এশিয়ার পাকিস্তান, নেপাল ও আফগানিস্তানের তুলনায় ভালো। উন্নয়ন সহযোগীদের পরামর্শক্রমে প্রণীত ‘জাতীয় দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র' ও 'জাতীয় দারিদ্র্য নিরসন কৌশলপত্র-২: দিন বদলের পদক্ষেপ' বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশকে ২০২১ সাল নাগাদ একটি শক্তিশালী মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত করার লক্ষ্য নিয়ে বর্তমান সরকার কাজ করে যাচ্ছে। গত তিন দশকে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ। তৈরি পোশাক খাতে সারা বিশ্বে রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশ এখন দ্বিতীয় অবস্থানে।
দারিদ্র্য বিমোচন ছাড়াও সামাজিক বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষত শিক্ষার প্রসার, শিশু মৃত্যুহার হ্রাস ও নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছে বলে মত প্রকাশ করেছেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন। গত চার দশকে বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুহার প্রতি এক হাজারে ১৮৫ থেকে কমে ৪৮ জনে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার হার পাকিস্তান আমলের ১৭ ভাগ থেকে বেড়ে ৭৩ ভাগে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়নের ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এসেছে। সৃজনশীল পদ্ধতির মূল্যায়ন ব্যবস্থা, শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার, শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও নতুন পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রভৃতি বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। বর্তমান সরকার একসাথে ২৫ হাজারের অধিক রেজিস্ট্রার্ড প্রাইমারি এবং প্রায় ৩ শত কলেজ সরকারিকরণ করেছে। এটি শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবর্তন সাধনে একটি যুগান্তকারী ঘটনা। স্কুলে শিক্ষার্থী ভর্তি ও বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষার পাসের হার অনেক বেড়েছে, শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার কমেছে ও শ্রেণিতে নারী শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হার বেড়েছে। এছাড়া একীভূত শিক্ষা গ্রহণ করার ফলে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ কার্যক্রম সফলতা পেয়েছে। যার ফলে ভিশন-২০২১ এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার এগিয়ে যাচ্ছে।
নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বাস্থ্য রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম হলো— মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রদান, টিকা দান, দুস্থ নারীদের সহায়তা প্রকল্প, নারী শিক্ষা বিস্তারে উপবৃত্তি প্রদান ইত্যাদি। এসব পদক্ষেপ নারীর সার্বিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব রেখেছে। ২০১১-২০১২ অর্থবছরে ১ লাখ ১২ হাজার প্রসূতি নারীকে অনুদান দেওয়া হয়। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় ২০১০-২০১১ অর্থবছর থেকে শহর অঞ্চলের কর্মজীবী মায়েরা ‘ল্যাকটেটিং মাদার সহায়তা তহবিল' থেকে অর্থ সাহায্য পাচ্ছেন। নারীর প্রতি পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধে ২০১০ সালে প্রণীত হয়েছে ‘পারিবারিক সহিংসতা প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন'। নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় এ আইনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনে বিশেষত দরিদ্র মানুষের খাদ্য প্রাপ্তি ও পুষ্টির জন্য প্রণীত হয় ‘খাদ্য নীতি ২০০৬'। প্রান্তিক ও গ্রামীণ জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা দিতে সরকার বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি, যেমন-কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা), ভিজিএফ, ভিজিডি, টিআর প্রভৃতি পরিচালনা করছে। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার বছরে প্রায় ২০ লাখ টন চাল দুস্থ, নিরন্ন, প্রতিবন্ধী, শ্রমিকদের সরবরাহ করে। এছাড়া সরকার মুক্তিযোদ্ধাভাতা, বয়স্কভাতা, বিধবাভাতা, প্রতিবন্ধীভাতার মতো কল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা এবং পরিবেশ ও দুর্যোগ মোকাবিলা বিষয়ক বিভিন্ন কার্যক্রম ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে সরকার ইতোমধ্যে প্রশংসা অর্জন করেছে।
শিশুদের সুরক্ষা ও তাদের জীবন-বিকাশে সরকার ২০১১ সালে প্রণয়ন করেছে ‘জাতীয় শিশু নীতি ২০১১'। ১৮ বছরের কম বয়সী সকল ব্যক্তিই এ নীতি অনুযায়ী শিশু। জবরদস্তিমূলক ভারী ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের ব্যবহার এ নীতিতে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পথশিশু ও বিপথগামী শিশুদের বিকাশে পৃথক ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে। সাংস্কৃতিক অগ্রগযাত্রায়ও বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই। মাতৃভাষা বাংলা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা পেয়েছে। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে বাংলা ভাষা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষায় পরিণত হবে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি যে বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য এ দেশের ছাত্র ও সাধারণ মানুষ রক্ত দিয়েছিল, আজ সে দিনটি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত। এটি আমাদের দেশ ও জনগণের জন্য বড় অর্জন। বাংলাদেশের বাংলা বর্ষবরণ উদযাপনে যে মঙ্গলশোভাযাত্রার আয়োজন করা হয় তা ‘ইনট্যানজিবল হেরিটেজ' হিসেবে ইউনেস্কোর বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে। ফলে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
অনুশীলনী
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন :
১. মুজিবনগর স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কাঠামোটি ছকে উপস্থাপন কর। ২. স্বাধীনতা অর্জনে গণমাধ্যমের ভূমিকা চিহ্নিত কর। ৩. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা লেখ। ৪. ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানের মূল কারণ কী ? ৫. ‘স্বাধীনতা আমাদের দেশ ও জনগণের সবচেয়ে বড় অর্জন।'- কথাটির পক্ষে তোমার যুক্তিগুলো লেখ ।
বর্ণনামূলক প্রশ্ন :
১. স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান বর্ণনা কর। ২. যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠন প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা কর। ৩. ১৯৭২ সালের সংবিধানে বর্ণিত মূলনীতিসমূহ ব্যাখ্যা কর। ৪. জেনারেল এরশাদের নির্বাচন পদ্ধতি মূল্যায়ন কর।
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন :
১. মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী কে ছিলেন? ক. এম. মনসুর আলী খ. তাজউদ্দীন আহমদ গ. খন্দকার মোশতাক আহমেদ ঘ. এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান ২. মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্ব জনমত গঠনের জন্য সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব- i. স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনা করেন ii. গেরিলা যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন iii. বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বক্তব্য রাখেন নিচের কোনটি সঠিক ?
ক. i ও ii খ. ii ও iii
গ. i ও iii ঘ. i, ii ও iii
Read more